'অস্থিত্ববাদ' (Existentialism) দর্শন কী? সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের 'অস্থিত্ববাদ' দর্শন আলোচনা কর।
ভূমিকা: ১৮১৩ সালের ১৫ মে ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের জন্ম। পুরো নাম সোরেন আবি কিয়ের্কেগার্ড ওরফে সোকি। স্ক্যান্ডিন্যাভিয়ার সংস্কৃতির পীঠস্থান কোপেনহেগেনের বিত্তশালী ব্যবসায়ী মাইকেলে পেডারসন কিয়ের্কেগার্ডের দ্বিতীয় স্ত্রীর সপ্তম এবং শেষ সম্বল আমাদের সোকি। স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার এবং পারিবারিক আবেগীয় উত্তাপের অভাবের মধ্যে মানুষ হলেও স্বভাবের মধ্যে ছিলো জ্ঞানার্জনের প্রতি সোকির প্রচন্ড ঝোক। পিতার কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে গিয়ে সোকি পিতার মৃত্যপর্যন্ত-(১৮৩৮ পর্যন্ত) রুগ্ন-ভগ্ন-বিষন্ন-অবসন্ন-নিরস-নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। ইতোপূর্বে কিছুটা দার্শনিক-আলোর ছটা থাকলেও প্রকৃতক্ষে ১৮৪০ সালের পরে শুরু হয় কিয়ের্কেগার্ডের জীবনের দার্শনিক পর্যায়। সোরেন এর দর্শনে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। মানুষের জীবনদর্শন সোরেন কিয়ের্কেগার্ড নিজের জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে দার্শনিক মতবাদ দিয়েছেন।
জীবনের যাপিত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং অফুরণ অধ্যয়নের বদৌলতে সোকি একটি সমৃদ্ধ মানস-সম্পন্ন মানুষে পরিণত হন । পার্শ্ববর্তী দেশ জার্মানের দর্শন চিন্তার ও দার্শনিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের সুযোগ্য বাহক সভ্যতার ত্রানকর্তা হিসাবে পরিচিত হেগেল এবং কান্টের প্রবল প্রতাপে দার্শনিক দুনিয়ায় যখন ভাববাদি, বুদ্ধিবাদি, বস্তুবাদি এবং প্রকৃতিবাদি দর্শনের রৈ রৈ অবস্থায় একচেটিয়া চিন্তাধিপত্য তখন সোকি সম্পূর্ণ ভিন্ন-চিন্তা-জাত হয়ে ভিন্ন দৃষ্টির অথচ অত্যন্ত মৌলিক এবং স্বতন্ত্র দর্শনিক চিন্তাপ্রসূত ‘অস্থিত্ববাদ' তত্ত্বের জন্ম দেন। অনবরত-অক্লান্ত অফুরন্ত লেখালেখির মাধ্যমে তিনি ক্রমান্বয়ে তাঁর দার্শনিক চিন্তার বিকাশ ঘটান। তিনি মানুষের জীবনের তিনটি স্তরের বর্ণনা দিয়ে মানুষের অস্থিত্বের সরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেন। এবং একটি তাত্ত্বিক কাঠামোতে মত্ত থেকে কিয়ের্কেগার্ড দার্শনিক-দুনিয়ায় 'অস্থিত্ববাদ' নামের একটি যুগান্তকারী দর্শনের অস্থিত্ব সৃষ্টি করে। যা যতটা না দর্শনের সাথে যুক্ত তার চেয়ে সাহিত্যের সাথে বেশি সম্পৃক্ত।
অস্থিত্ববাদ দর্শন সৃষ্টির ইতিহাস: এক ঐতিহাসিক পটভূমিকায় উনিশ শতকে 'অস্থিত্ববাদি' দর্শনের জন্ম। আধুনিক যুগ হলো যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। চারদিকে শুধু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার জয়গান । বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারে মানুষ হয়েছে ধন্য কিন্তু তার সাথে হারিয়েছে নিজেকে, নিজের ব্যক্তিসত্তাকে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে। প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভুত্ব বিস্তার করেছে মানুষের উপর। মানুষ হয়েছে যন্ত্রের ক্রীতদাস। তাই মানুষ নিজের অস্থিত্ব ,স্বাধীনতা এবং মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে বেশি সচেতন হয়েছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার সম্বন্ধে অস্থিত্বের চেয়ে তার কাছে অনেক বেশি প্রিয়-মুল্যবান-গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যন্ত্রশিল্প, কারখানা, গাড়ি, রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি। অন্যান্য সব কিছুর চেয়ে নিজের অস্থিত্বকে গুরত্বায়নের ভিত্তিতে ভাববাদি এবং প্রকৃতিবাদি দর্শনের এক প্রকার তুড়াই-বিরোধীতা করে অস্থিত্ববাদি দর্শনের জন্ম।
দাস যুগের গ্রীস দার্শনিক প্লেটোর মতানুযায়ী বস্তুজগৎ বাস্তবত অস্থিত্বশীল নয়। বুর্জোয়া যুগের জার্মান দার্শনিক হেগেল চরম ভাবকে বলেছেন যথার্থ সত্য বলে। আবার তিনি ব্যক্তি সত্তার অস্থিত্বকে দেখেছেন সামগ্রিক ও সামাজিক সত্তার অংশ রূপে। দর্শনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সার্বিকতা এবং সার্বজনীনতার বিপরীতে অস্থিত্ববাদি দৰ্শনিক চিন্তার সুত্রপাত । অস্থিত্ববাদি দার্শনিকরা প্রয়াসি হলেন চরম ভাববাদি, যুক্তিবাদি ও সামগ্রিক তথা সার্বিকতাবাদি দর্শনের বিরুদ্ধে আপাত সত্য, ভাবাবেগ ও ব্যক্তিসত্তার অস্থিত্বকে আশ্রয় করে দর্শনের জগতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে । একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করতে। তাদের মতে যুক্তির জাল বুনে দার্শনিকরা শুধু কথা মালাই তৈরী করতে পারেন, কিন্তু তাতে মানুষের কোন মঙ্গল সাধিত হয়না বা হতে পারে না । এ অলীক ও অবাস্তব তত্ত্বানুসন্ধানের পরিবর্তে দার্শনিকদের দায়িত্ব হওয়া উচিত মানুষকে লক্ষ হিসাবে গ্রহণ করা, মানুষের বাস্তব সমস্যাবলি সমাধানের আত্মনিয়োগ করা।
এক্ষেত্রে ত্রানকর্তারর ভূমিকা এবং অস্থিত্ববাদি দর্শনের জনকের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন সোরেন কিয়ের্কেগার্ড । যদিও অস্থিত্ববাদি দর্শনকে জ্ঞানকান্ডের একটি সমৃদ্ধ শাখায় রূপান্তর করেন জ্যাঁ-পল সাত্রে, কিন্তু সোরেন কিয়ের্কেগার্ডকেই মূলত 'অস্থিত্ববাদি' দর্শনের জনক বলা হয়। কেননা খোদ 'অস্থিত্ববাদি দর্শনের মহারাজা এবং ফরাসি সভ্যতার বিবেক তকমাধারী মহাত্মা জ্যাঁ-পল সাত্রেও কিয়ের্কেগার্ডকে এ তত্ত্বের গুরু হিসাবে মান্য করেছেন। কিয়ের্কেগার্ড উপলব্দি করেছিলেন যে, কান্টের দর্শন ও হেগেলের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সবই মানষের ব্যক্তিক জীবনে অর্থহীন। কেননা, ব্যক্তির সিদ্ধান্তের উপরেই ঘটনাবলীর গতি প্রকৃতি নির্ভরশীল। তাই সবকিছু বিচার-বিবেচনা-বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে মানুষের অস্থিত্বশীল জীবনকেই গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যসবকিছু বিদ্যমান একথা সত্য কিন্তু মানুষের জীবনই একমাত্র অস্থিত্বশীল এ কথা ধ্রুব সত্য । কিয়ের্কেগার্ড মানুষের এ অস্থিত্বশীল জীবনকে গুরত্বায়ন করেই তার এ যুগান্তকারি 'অস্থিত্ববাদ' (Existentialism) দার্শনিক তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।
যা পরবর্তীতে, ইয়েসপার্স, মার্সেল, নীটশে, হাইডেগার প্রমুখের হাতে লালিন-পালিত হয়ে জ্যাঁ-পল-সাত্রের হাতে পূর্ণ যৌবন লাভ করে । মজার ব্যাপার হচ্ছে, যৌবন লাভ করে, তা আর কোনভাবেই বৃদ্ধ হচ্ছে না। সময় যত গড়াচ্ছে, বয়স যত বাড়ছে, এর রূপ যৌবন ততই বাড়ছে। কেবলই বাড়ছে। তাজ্জব ব্যাপার।
কিয়ের্কেগার্ড বলেন মানুষের জীবনের তিনটি স্তর লক্ষ্য করা যায়, যথা-
১. ভোগী স্তর (aesthetic stage),
২. নৈতিক স্তর(Ethical stage) এবং
৩.ধর্মীয় স্তর (Religious stage)।
জীবনের এ তিনটি স্তরের কথা যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে কিয়ের্কেগার্ড তাঁর 'অস্থিত্ববাদি' দর্শনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। আর এ তিনটি স্তরকে বোঝার জন্য কিয়ের্কেগার্ড তাঁর 'ফিলিস্তিন' প্রত্যয়টি পয়দা করেন।
'ফিলিস্তিন' তত্ত্ব ও জীবনের ৩ টি স্তরের সাধারণ আলোচনা: কিয়ের্কেগার্ড মুলতঃ অন্ধ ধর্মবিশ্বাস থেকে যারা খৃষ্টান হিসাবে দাবি করে, খৃষ্টান বলে পরিচিতি জাহির করে এবং খৃষ্টান ধর্ম চর্চা করে তাদের আঘাত করার প্রয়াসে 'ফিলিস্তিন' শব্দটি ব্যাবহার করেন। কিয়ের্কেগার্ডের মতে, একজন ফিলিস্তিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে সব সময় অসচেতনভাবে সামাজিক মূল্যবোধকে বহন করে, সামাজিক রীতিনীতি দ্বারা মানসিক রুচিকে লালন করে অর্থাৎ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়।
একজন ফিলিস্তিন সাধারণভাবে গৃহিত রীতিনীতি ও বিদ্যমান আদর্শকে আকড়ে ধরে। এবং যেহেতু সমাজের অচলায়তনকে ভাঙ্গার কোনে আর্তি সে অনুভব করে না, তাই সে তার পেশা ও পরিবার এবং সাফল্য ও সুখের গন্ডিতেই তৃপ্ত থাকে । তার নিজের ধারনা যে, সে স্বাধীন জীবন যাপন করে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং নিজের পছন্দ-অপছন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে। অবশ্য আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তাই মনে হয়। মনে হয় যে, সে অনেক বিকল্প বিষয় থেকে তার পছন্দানুযায়ী একটিকে বেঁচে নেয়। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, আসলে তার সব সিদ্ধান্তই বা সিদ্ধা- সমূহের নির্ধারক হচ্ছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক শক্তিসমূহ। সামাজিকভাবে অচেতন থেকেই সনাতন জীবন পদ্ধতির কাঠামোর ভেতর ঐতিহাসিকভাবে চলনশীল এবং বিশ্বাস-নির্ভর চলমানতায় একজন ফিলিস্তিন তার জীবন পরিচালিত করে। এ কারণেই আপাত দৃষ্টিতে তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তার নিজের- এটা মনে হলেও কখনই তার নিজের সিদ্ধান্ত সে নিজে নেয় না। কোন সিদ্ধান্তই তার নিজের না। কিন্তু সেটা সে উপলব্দি করতে পারে না। কেননা, সে জানে না যে সে একজন ফিলিস্তিন। কিয়ের্কেগার্ডের এ তত্ত্বের আয়নায় আমরা নিজেদের চেহারা-মুবারক'টা একবার পরখ করতে পারি । মোদ্দা কথায় আসা যাক। কিয়ের্কেগার্ড মানুষের এ ‘ফিলিস্তিন' অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ-পন্থা-পর্যায় হিসাবে তিন ধরণের জীবনের তত্ত্ব বাতলে দেন। প্রথমে ‘ভোগী', পরে 'নৈতিক' এবং অতঃপরে 'ধর্মীয়'।
১. ভোগী স্তর (aesthetic stage): কিয়ের্কেগার্ড তার 'aesthetical' বইগুলো এমন তরিকায় রচনা করেছেন, কিয়ের্কেগার্ডের ধারণা এ বই পাঠ-উত্তর একজন ‘ফিলিস্তিন' তার জীবনের অসারত্ব-অচেতনত্ব-তলাহীনত্ব সম্পর্কে অবহিত হবেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত-ধারণা-চিন্তার মুখোশ সম্পর্কে অবগত হবেন। তার নিজের বিশ্বাস ভঙ্গ করে পুনরায় নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন। কিয়ের্কেগার্ডের মতে, যখনই একজন ফিলিস্তিন বুঝতে পারে যে, তার মূল্যবোধ, সিদ্ধান্তসমূহ এবং তার জীবনের উদ্দেশ্য-ইত্যাদির পেছনে তার নিজের কোন ভূমিকা নেই, সবই প্রচলিত সামাজিক কাঠামোসমূহের আপেক্ষিক ও আকস্মিক চরিত্র দ্বারা নির্ধারিত, তখন তার ভ্রম কেটে যায়। সে সবকিছুর প্রতি নিস্পৃহ হয়ে পড়ে, কারণ তার পছন্দ বা সিদ্ধাদের কোনটিই চূড়ান্ত অর্থে তার নিজের নয়। কোথাও সে নিজেকে খুজে পায় না। সব কিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। কোন কিছুকেই আর সে গুরত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে না।
নিজের অস্থিত্বের অসারত্ব উপলব্দিতে তার সব কিছুকেই ফেকাসে মনে হয় । বর্ণিল জীবন বিবর্ণ হয়ে উঠে। হতাশা-নৈরাশ্য তাকে গ্রাস করে। বিষণ্নতা অবসন্নতা তাকে অনুসরণ করে। অকর্মণ্যতা-অনিশ্চতা-অনাড়ম্বতা তাকে ঘিরে ধরে। অস্থিরতা-অস্থিত্বহীনতা তাকে বিচলিত করে। ঠিক যে মুহুর্তে একজন 'ফিলিস্তিন' আবিষ্কার করে যে, সে একজন 'ফিলিস্তিন' এবং তার অর্থ কি! সঙ্গে সঙ্গে সে অন্য কিছুতে পরিণত হয় । সে একজন এস্থেটি(aesthete) হয়ে যায়।
জীবন সম্পর্কে হতাশা এবং নৈরাজ্য-চিন্তা একজন ‘এস্থেটি'কে স্বেচারী করে তোলে। তার কাজ-কর্মে-চিন্তায় ব্যবহারে-আচরণে-প্রজ্ঞায় সে অনৈতিক এবং বিবেকহীন হয়ে উঠে। জীবনের প্রতি মায়াহীনতা এবং মোহহীনতা তাকে অবিবেচক-অসামাজিক করে তোলে। নিজের অস্থিত্বের অসারতা একজন 'এস্থেটি'কে অস্থিতিশীল করে তোলে। কিয়ের্কেগার্ডের মতে, এটা মানুষের জীবনের প্রথম স্তর। অর্থাৎ অস্থিত্বের চেতনাহীন ফিলিস্তিন অবস্থা থেকে অস্থিত্বের চেতনায় পদার্পনের পর 'এস্থেটি' রূপ ধারণ-এটা মানুষের জীবনে প্রথম স্তর।
এ স্তরে মানুষ থাকে ভোগ বিলাসে মগ্ন, সমাজ ও অন্যের প্রতি তার কোন দায়িত্ব থাকেনা, তার দৃষ্টি শুধু থাকে নিজের আরাম আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দের দিকে, সুখ ও ভোগের দিকে। এ জীবন দায়িত্বহীন, নৈতিকতাহীন, অস্থির, অপ্রতিজ্ঞাবদ্ধ, উদ্দেশ্যহীন এবং ক্ষণস্থায়ী। এ স্তরে কোন সংযম নেই, কোন আত্ম-অনুশাসন নেই, দায়িত্ব, কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা নেই। আছে শুধু ইন্দ্রিয়ের তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি বিধান এবং খেয়াল খুশির চরিতার্থতা।
কিয়ের্কেগার্ড এ স্তরের উদাহারণ হিসাবে তিনটি ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা উল্লেখ করেন । চরত্রিগুলো হলো, ডন জুয়ান, ফাউস্ট এবং আহাসুরাজ।
মোজার্টের অমর অপেরার, ডন জুয়ান হলো আমোদ প্রমোদ, ভোগ-লালসা এবং চরম অনৈতিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
অন্যদিকে গ্যাটের অমর কীর্তি, ফাউস্ট একজন বিকৃত মানুষ । যৌনসুখের সন্ধানে সে নৈতিকতার কোন দোহাই মানতে নারাজ। সে যৌনকর্মের সুখানুভূতির চেয়ে যৌনকর্মের পদ্ধতিতেই বেশি আগ্রহী। এবং তার প্রাপ্তি যখন শেষ হয়, তখন সে নিষ্কৃতি পেতে চায়। প্রয়োজনে তার সঙ্গীকে খুন করে হলেও । কোন ধরণের বিবেকবোধ-নৈতিকতাবোধ-বিবেচনাবোধ এখানে প্রশ্রয় পায় না।
সর্বশেষ চরিত্র আহাসুরাজ একজন ইহুদি। হতাশা-জরাগ্রস্থ-নিরানন্দ একটি জীবনকে বয়ে বেড়ানোই এর বৈশিষ্ট্য। একজন ভ্রামনিক হিসাবে সে যায়নি এমন কোন জায়গা নেই, দেখেনি এমন কোন জিনিস নেই । কিন্তু স্থায়ীভাবে বসবাস করার কোন যোগ্য জায়গা তার নেই। এ ধরনের অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা তার জীবনে এনে দেয় ঔদাসিন্যতা-নিস্তেজতা, নিরানন্দতা-একঘেয়েমিতা-বিষণ্নতা-অবষণ্নতা।
জীবনের এ স্তরে যে, শুধু সুখ আছে তা নয়। এই স্তরের জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, পুনরাবৃত্তি, ব্যর্থতা, একঘেয়েমি জনিত বিরক্তিও আছে । কিয়ের্কেগার্ডের মতে কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির চরিতার্থতা এবং বিমূর্ত দর্শন চিন্তায় মগ্ন থাকলে, তা অনিবার্যভাবে মানসিক ক্লান্তি এবং অবসাদ নিয়ে আসে। অবিরত বিষণ্নতা, অসহ্য, একঘেয়েমি এবং পুনরাবৃত্তির ক্লান্তি একজন ‘এস্থিটি'কে শূন্যতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে।
তখন একজন 'এস্থিটি' নতুন করে তার অস্থিত্বকে উপলব্দি করে। ভোগী জীবনের অসারতা এবং অনৈতিকতা তাকে দংশন করে। সে নতুন করে উপলব্ধি করে যে, কেবল খাদ্য, পানীয় ও আনন্দই জীবনের সব কিছু নয়। কাল তো মারা যাবই । মানুষের ভালোবাসা, আশির্বাদ, মায়া, মমতায় আবদ্ধ জীবনের সামাজিক বন্ধনেই জীবনের আসল সুখ । অস্থিত্বেই আসল আনন্দ। যখনই একজন 'এস্থিটি'র এ উপলব্দি মনের-চৈতন্যে জাগ্রত হয়, তখনই সে নতুন একটি পর্যায় পদার্পন করে। কিয়ের্কেগার্ড একে বলেছেন জীবনের দ্বিতীয় স্তর বা পর্যায়। এটা হচ্ছে নৈতিকতার পর্যায় বা Ethical Stage।
২. নৈতিক স্তর(Ethical stage): কিয়ের্কেগার্ডের মতে, জীবনের হতাশা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় জীবনের নৈতিকতার স্তর। এ পর্যায়ে কোন ব্যক্তি (ethical) নৈতিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন, বৈবাহিত জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, স্থায়ীভাবে কোন একটা পেশায় নিয়োজিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সমাজের রীতিনীতি মেনে চলতে বদ্ধ পরিকর।
কিয়ের্কেগার্ড জীবনের নৈতিক স্তরের বিবরণ দিতে গিয়ে 'দৃঢ় সংকল্প' এবং 'দায়িত্ব'-এর কথা বলেছেন। হেগেলের ‘চিন্তার দ্বান্দ্বিকতা’কে কিয়ের্কেগার্ড দূর করতে চেয়েছেন ‘মনোনয়নের দ্বান্দ্বিকতা' দিয়ে। নৈতিক স্তরে একজন মানুষ নিজেকে একজন সামাজিক জীব হিসাবে এবং সমাজের অংশ হিসাবে চিন্তা করে। সমাজের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তা করে। সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা তার নৈতিক দায়িত্ব মনে করে। ফলে, এ কর্তব্য সম্পাদন করতে গিয়ে তাকে মনোনয়ন করতে হয়, কোন নীতি অনুসরণ করে চলতে হয়। মানুষকে বিচার করতে হয় উদ্দেশ্য হিসাবে, উপায় হিসাবে নয়।
কিয়ের্কেগার্ড নৈতিক স্তরে একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দিয়েছেন সক্রেটিসকে। কেননা তাঁর মতে, সক্রেটিসই শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ন মানুষ। মানুষ এবং মানুষের কর্তব্যের প্রশ্নে সক্রেটিস ছিলেন সদা আগ্রহী। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ছিলো তার জীবনের একমাত্র এবং প্রধান লক্ষ্য। নৈতিকতাতেই সক্রেটিসের ছিলো সমান আগ্রহ। যা কিছু কল্যাণকর এবং ভালো, তার কথা তিনি শুধু বলতেনই না, ব্যক্তি জীবনে তিনি তা প্রয়োগ করতেন। সক্রেটিসের সারাজীবনের কর্ম, তাঁর চিন্তা-ভাবনা, তাঁর দেয়া নৈতিক শিক্ষা-এক কথায় ইউরোপীয় সভ্যতার এক প্রধান পুরুষ সক্রেটিস।
এভাবে তিনি নৈতিক স্তরের প্রশংসা প্রকাশ করলেও মানুষের অস্থিত্বের অনুষঙ্গ হিসাবে কিংবা অস্থিত্বের পরিনতি হিসাবে কিংবা অস্থিত্বের সর্বোচ্চ স্তর হিসাবে ধর্মীয় স্তরকে (Religious stage) গুরত্বায়ন করেছেন।
৩.ধর্মীয় স্তর (Religious stage): কিয়ের্কেগার্ড মানুষের জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় নৈতিকতার থেকে তৃতীয় পর্যায় ধর্মীয় স্তরে যাওয়ার কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন সমষ্টিকতা এবং ব্যষ্টিকতার মধ্যকার দ্বন্দ্ব-জাত পাপকে ।
এবং এ পাপ মোছনের পর্যায় হিসাবে তিনি ঈশ্বরের নির্বিচার আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের উপায় হিসাবে ধর্মীয় স্তরের বয়ান করেন। বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বলা দরকার। নৈতিকতা হলো সার্বিক এবং সার্বিক হিসাবে এটা সর্বকালে সবারই জন্য বৈধ। কিন্তু এ সার্বিকতাকে মানতে গিয়েই নৈতিক ব্যক্তিকে উভয় সংকটে পড়তে হয়। তার নৈতিক কাজ হলো সার্বিকতার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করা করা, সার্বিক হওয়ার জন্য নিজের স্বাতন্ত্রকে বর্জন করা। কিন্তু সে যদি নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে প্রকাশ করে, তাহলে সে পাপ করে, কেননা সে তখন সার্বিকতা থেকে দুরে সরে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় ।
অন্যদিকে সে যদি নিজের স্বাতন্ত্রকে প্রকাশ না করে, তাহলে একইভাবে পাপ করে, কেননা যথার্থ অস্থিত্বের জন্য তার যা করা উচিত-সে তা করছে না, তার যা প্রকাশ করা উচ্চত তা সে প্রকাশ করছে না বলে তখন সে অভিযুক্ত হয়। যেদিকেই সে যাক না কেন, পাপ থেকে তার রক্ষা নেই। এ এক মহা বিপদের কথা । বড় মুশকিলের কথা । কিয়ের্কেগার্ড এ মুশকিল অবসান করার পথ বাতলে দিয়েছেন । কিয়ের্কেগার্ডের মতে, এ উভয় সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ধর্মীয় জীবন। কিয়ের্কেগার্ড বর্ণিত 'ধর্মীয় স্তর'(Religious Stage)।
কিয়ের্কেগার্ডের মতে, ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য হলো ‘বিশ্বাস’ ও ‘অন্তর্মুখিতা’। আত্মনিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে এবং মুক্ত হৃদয় নিয়ে অকপটে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে 'বিশ্বাস' প্রদর্শিত হয়। আর পাপ ও হতাশাকে এ বিশ্বাসের মাধ্যমে জয় করা যায়।
কিয়ের্কেগার্ডের মতে, ধর্মীয় জীবন নৈতিকতার স্তরের চেয়ে উন্নত জীবন। এখানে বিশ্বাসের মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভই বড় কথা । নৈতিকাতার প্রশ্নও এখানে ছোট হয়ে যেতে পারে বিশ্বাসের বৃহত্তর প্রয়োজনে।
কিয়ের্কেগার্ড উদাহরণ হিসাবে অর্থাৎ ‘ধর্মীয় স্তরে অস্থিত্বের দৃষ্টান্ত হিসাবে ইব্রাহিমের (ইসমাইল ট্রাজেডি) কথা বলেছেন। ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য মহাত্মা ইব্রাহীম কর্তৃক তার স্বীয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দেয়ার ঘটনাটি নৈতিকতার দৃষ্টিতে অবশ্যই একটি বড় অপরাধ। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা মোটেই বড় অপরাধ নয়। ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য বা নিজের জন্য নিজের পরিত্রানের জন্য এ ধরনের নৈতিকতা বিরোধী কাজেরও যৌক্তিকতা আছে বৈকি। কিয়ের্কেগার্ড এ স্তরে এসেও নৈতিকতাকে একেবারে বর্জন করতে বলেননি। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, ঈশ্বরের নৈকট্য ও করুণা লাভের জন্য সাময়িকভাবে নৈকিতাকে স্থগিত রাখার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ব্যক্তি মানুষ যখন নৈতিকতাকে স্থগিত রাখে, তখন সে থাকে সার্বিকতার উর্ধ্বে, সমাজ ও সার্বিকতার চেয়ে সে হয়ে উঠে শ্রেষ্ঠ। মানুষ নৈকিতার পতাকাতলে জীবন যাপন করবে সত্য। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য, ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য, ঈশ্বরের তৃপ্তির জন্য যখন ধর্মের বেদিমূলে অবস্থান নেবে , তখন সে সকল প্রকার সার্বজনীনতার ঊর্ধ্বে-সার্বিকতার উপরে নৈতিকতার অপারে(অসীম)। সার্বিক নৈতিকতার উর্ধ্বে ধর্মীয় জীবনের এ স্তরটিই কিয়ের্কেগার্ডের মতে মানুষের একমাত্র যথার্থ অস্থিত্ব। কিয়ের্কেগার্ড মনে করে জীবনের স্তর সম্পর্কে তার বর্ণিত মতবাদে মানুষের অস্থিত্বের সব দিক অন্তর্ভুক্ত।
সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের অস্থিত্ববাদের সমালোচনা: আলোচনার শেষে এসে কিয়ের্কেগার্ডকে একবার সমালোচনার কাঠগড়ায় দাড় করানো যাক। কিয়ের্কেগার্ডের ‘অস্থিত্ববাদি' তত্ত্বকে আমাদের যুক্তির মর্টেম ঘরে টেনে সামান্য পোস্ট-মর্টেম করা যাক। কিয়ের্কেগার্ড বর্ণিত জীবনের বিকল্প অস্থিত্ব হিসাবে 'এস্থেটি' কিংবা ‘এথিক্যাল' কোনটিতেই চরমভাবে স্থান না নিয়েও একজন মানুষ তার অস্থিত্বে এ দু’য়ের সহাবস্থান গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ একজন মানুষের মধ্যে একজন ‘এস্থেটি’ এবং একজন ‘এথিক্যাল' মানুষের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় হতে পারে, যা কিয়ের্কেগার্ড উল্লেখ করেননি। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বাস্তবিক এবং প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিষয়টি সাফ হয়।
মানুষ মাত্রই ভোগ বিলাস প্রত্যাশি। আমরা সবাই কামনাকে তৃপ্ত করতে চাই, আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে চাই এবং জীবনের একঘেয়েমিকেও এড়াতে চাই । কিন্তু এসব কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে আমরা আমাদের বিবেক দ্বারা চালিত হতে পারি। যেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত সেখানে নিজেদের সংযম করতে পারি। সে অর্থে আমরা ‘নৈতিক' হতে পারি। ভোগ-বিলাসকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রেখে আমরা ‘এস্থেটি'ও হতে পারি ।
আবার, সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য-সাংসারিক দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করেও কিংবা সামাজিক মানুষ হয়েও আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করতে পারি, জীবনকে উপভোগ করতে পারি। সে অর্থেও আমরা ‘এস্থেটি' এবং 'এথিক্যাল' উভয়ের সমন্বয় ঘটাতে পারি। কিয়ের্কেগার্ড অস্থিত্বের এ যৌথ দিকটিকে এড়িয়ে গেছেন। অধিকন্তু, এক দাগ বাড়িয়ে আমরা একই অঙ্গে তিন রূপও দেখতে পারি। অর্থাৎ একজন মানুষ ভোগ-বিলাস-আনন্দ-ফূর্তিকে নৈতিকতার মাত্রা সীমাবদ্ধ রেখে সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে একটি সার্বিক এবং সামাজিক মানুষ হয়ে একাধারে ‘এস্থেটি' এবং 'নৈতিক' উভয়ই হতে পারে। পাশাপাশি, যুগপৎ ‘এস্থেটি’ এবং ‘এথিক্যাল' হয়েও ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য ধর্ম-কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। সে অর্থে, একজন মানুষ ‘একের ভেতর তিন’ হতে পারে। অর্থাৎ একই সাথে তিনটি অস্থিত্বের সমন্বয় হতে পারে। কিয়ের্কেগার্ড এ বিষয়টিও এমনভাবে এড়িয়ে গেছেন।
তথাপি, একজন মানুষের সমগ্র জীবনকে পর্যায়ক্রমে ভাগ করলে আমরা কিয়ের্কেগার্ডের তত্ত্বের যথার্থতা দেখতে পাই । একজন মানুষ প্রথম জীবনে বিশেষ করে যৌবনকালে ভোগ-বিলসি হয়। অনেক ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে অতিক্রম করে আনন্দ-ফূর্তি করে . নিজের আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়। এটা ‘এস্থেটি' স্তর। কিন্তু একটা সময় এসে বিয়ে-সংসার করে সে সামাজিক জীবন যাপন করে। সাংসারিক দায়বদ্ধতা সে পালন করে। বৃদ্ধ বাবা-মার সেবা-যত্ম করে সামাজিক এবং সার্বিক মানুষ হয়ে উঠে । এটা ব্যক্তির ‘এথিক্যাল' স্তর। এবং একটা বয়সে এসে মৃত্যুচিন্তা থেকে মানুষ ধর্ম-কর্মে মনোনিবেশ করে । এবং ধর্ম-কর্ম করে মানুষ আত্মার শান্তি অনুভব করে। এটা ‘ধর্মীয়’ স্তর। এভাবে আমরা কিয়ের্কেগার্ডের ‘অস্থিত্ববাদি’ তথ্যের একটি বাস্তব চিত্র অংকন করতে পারি।
কিয়ের্কেগার্ডের 'ফিলিস্তিন' সম্পর্কিত ‘অস্থিত্ববাদি’ তত্ত্বের বক্তব্যে আমরা মানুষের জীবনের কিংবা মানুষের অস্থিত্বের তিনটি স্তরের কথা অবগত হলাম। এবার তত্ত্বের দার্শনিক ভার থেকে সামান্য ছুটি নিয়ে খোশ-গল্পের মাধ্যমে হালকা হওয়ার চেষ্টা করি। গল্পের সাথে সাথে, তত্ত্বের মাপকাঠিকে নিজেদেরকে একবার মাপঝোক করে দেখি। নিক্তির ভারসাম্যতায় আমরা আমাদের চেহারা সুরতটা একবার দেখার চেষ্টা করি। আমরা কি সবাই 'ফিলিস্তিন'? না কেউ কেউ ‘এস্থেটি' কিংবা 'এথিক্যাল' নাকি একেবারে সার্বজনীনতার উর্ধ্বে বা নৈতিকতার অপারে অন্ধ ‘ধর্মীয় পর্যায়ে ? বড় জটিল প্রশ্ন। তাছাড়া, আমরা ‘ফিলিস্তিন' স্তরই আদৌ পার হতে পেরেছি কিনা সেটাই ফয়সালা হয়নি, অস্থিত্বের অন্য তিনটি স্তরের কোন স্তরে আমাদের অবস্থান সেটা আসছে পরের ব্যাপার।
এসব গুরুগম্ভীর প্রশ্ন-উত্তরের সমাধান একেবারে নিজের প্রকার ও প্রকৃতির অধীন। তাই এ তর্কের এখানেই শেষ। তবে সাধারণ বিচারে দেখা যায়, আমরা বেশির ভাগ মানুষই ফিলিস্তিন। নিজেদের মগ্ন-চৈতন্যের মুঢ়তায় অন্তর্গত রুচির বিকাশের অভাবে আমরা সামাজিক প্রথা পরিক্রমায় নিজেদের জীবন যাপন করি। আমরা 'জীবনে'র চেয়ে 'যাপন' কে অধিকতর গুরুত্ব দিই। আমরা, ‘উপভোগে’র চেয়ে 'ভোগে' বেশি তৃপ্ত হই। আমরা 'চলতে' জানিনা 'চালিত' হই। আমরা 'দৃষ্টি' দিয়ে দেখিনা ‘অদৃষ্ট' চোখে দেখি। আমরা 'মনের জোরে' চলিনা ‘গায়ের জোরে' চলি। তাই আমরা 'ফিলিস্তিন'। কেননা, আমরা জানিনা যে, আমরা 'ফিলিস্তিন'। আমরা 'আপন'কে চিনতে পারিনা বলেই আমরা ‘অপরকে' চিনতে পারিনা। আমরা ‘অপরকে' চিনতে পারি না বলেই, পর কখনো আমাদের ‘অ-পর' হয়না। আমরা এখনো যে, 'ফিলিস্তিন' স্তরে অবস্থান করছি সেটাই বুঝতে পারছিনা। তাই, ভোগী স্তর, নৈতিকতার স্তর, কিংবা ধর্মীয় স্তর আমাদের কাছে এখনও বহুদুর। কে জানে কতদুর? কে জানে এ হতভাগ্য 'দুর' করে 'দুর' হবে। খুলবে জ্ঞানের দীপ্তিতে জীবনের সোনালি দোর। আসবে অস্থিত্বের আনন্দ নিয়ে রূপালি ভোর। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
॥ তথ্যসূত্র ॥
১. পৃষ্ঠা-১১। পাশ্চাত্য দর্শনে ইতিহাস, কান্ট-হেগেল" শ্রী মনোরঞ্জন বসু, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুষ্ক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৬ www.webcom.com/entries/kierkegaand-mi tvmlpZ | BIrmeZ |
২. ‘অস্থিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নীরকুমার চাকমা বাংলা একাডেমি ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-৪
৩. 'অস্থিত্ববাদ' শরীফ হারুন, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা-১১
৪. "An Introduction to Western Philosophy, Ideas and Arguments from Plato to Satre-Anthony Flew. The Boobs-Merrill Company, New York, Page-462
৫. Six Existential Thinkers', H.J. Blackham, Routledge, London and New York, 1994, Page-12
৬. 'অস্থিত্ববাদের স্রষ্টা সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, গোলাম ফারুখ, অবসর প্রকাশনী, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৪৮
৭.Kierkegard Godly Deceiver Holmes Hartshorne, Columbia University Press, New York, Page- 19
৮. Republic', Plato, Oxford University Press, London, 1990, Book-VII- Lvthdz ci |
[বি.দ্র. এই অ্যাসাইনমেন্টের সম্পূর্ণ অংশই বড় প্রশ্ন ও টীকা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য!]
অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ। সাত্রের দর্শন।অস্তিত্ববাদ ও শিক্ষা।অস্তিত্ববাদ ।অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বগামী।অস্তিত্ববাদ কী।অস্তিত্ব সার সত্তার পূর্বগামী এটি কার উক্তি।অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য।
0 মন্তব্যসমূহ